সক্ষমতার তিন গুণেরও বেশি রোগী ভর্তি থাকে এমএমসি হাসপাতালে
ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের বাসিন্দা আলেয়া বেগম (ছদ্মনাম)। বেশ কিছুদিন ধরে ঠাণ্ডাজনিত সংক্রমণে ভুগছেন ষাটোর্ধ্ব এ নারী। সঙ্গে দেখা দিয়েছে শ্বাসকষ্ট। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক) হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসেন তিনি। চিকিৎসকদের কথামতো ভর্তি হয়ে গেলেও শয্যা খালি না থাকায় শেষ পর্যন্ত তার ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালের সিঁড়িতে। এ বৃদ্ধার মতো জটিল রোগ নিয়ে ভর্তি হওয়া আরো অনেক রোগীকে এভাবে হাসপাতালের মেঝেতে শুয়ে চিকিৎসা নিতে দেখা যায়।
বর্তমানে ধারণক্ষমতার তুলনায় প্রতিদিন গড়ে তিন গুণেরও বেশি রোগী ভর্তি থেকে হাসপাতালটিতে চিকিৎসা নিচ্ছে। ইনডোর ও আউটডোর মিলিয়ে হাসপাতালটিতে প্রতিদিন গড়ে চিকিৎসা নেয় প্রায় নয় হাজার রোগী। জনবল ও অবকাঠামো সংকটের কারণে চিকিৎসাসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। বিপুলসংখ্যক রোগীর চাপ সামলে প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। রোগীর চাপ বেশি থাকায় এখানকার চিকিৎসকদের পক্ষে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় চিকিৎসা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ হাসপাতালটির স্বাস্থ্যসেবাপ্রত্যাশীদের।
বিপুলসংখ্যক রোগীর চাপ সামাল দেয়ার জন্য হাসপাতালটির অবকাঠামোগত সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করছেন হাসপাতাল পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত চিকিৎসকরাও। ভবন সংকটের কারণে চিকিৎসা দেয়া কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে বলে জানালেন হাসপাতালটির সহকারী পরিচালক (প্রশাসন) ডা. মাইন উদ্দিন মানিক।
তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে চিকিৎসক সংকট রয়েছে যা পর্যায়ক্রমে পূরণ হচ্ছে। কিন্তু ভবন সংকটের কারণে রোগীদের সুষ্ঠুভাবে সেবা দেয়া খুবই কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে। রোগী অনুপাতে সুষ্ঠু চিকিৎসার জন্য আরো চিকিৎসক-নার্সসহ জনবল বৃদ্ধি প্রয়োজন। প্রতিদিন এ হাসপাতালে গড়ে নয় হাজার রোগী চিকিৎসা নেয়। এত মানুষকে চিকিৎসা দিতে যে পরিমাণ ভবন দরকার তা নেই এ হাসপাতালে। জরুরি ভিত্তিতে ভবন নির্মাণ ও জনবল নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ বুলেটিন ২০২৩-এর তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালটির মোট শয্যা সংখ্যা এক হাজার। আর হাসপাতালটিতে বেড অকুপেন্সি রেট বা শয্যাপূরণের হার ৩২৬ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ ২০২৩ সালে এখানে প্রতিদিন গড়ে রোগী ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছে শয্যা সংখ্যার সোয়া তিন গুণেরও বেশি। বর্তমানে এ সংখ্যা আরো বেড়েছে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও চিকিৎসক সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
২০২৩ সালে হাসপাতালের বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ১১ লাখ ৫২ হাজার ৫৯৪ রোগী। জরুরি বিভাগে চিকিৎসা নিয়েছে ৬৯ হাজার ৫৯০ জন। আর চিকিৎসার জন্য ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ৩ লাখ ১৩ হাজার ৫৮১।
মমেক হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. মো. আলী রেজা সিদ্দিকী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘১৯৬২ সালে হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি একাধিকবার দেশসেরা সরকারি হাসপাতালের স্বীকৃতি অর্জন করেছে। সরকারি পরিকল্পনা ও অর্থ বরাদ্দ ছাড়া স্থানীয় ব্যবস্থাপনা ও দান-অনুদানের মাধ্যমে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে দেশের মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোর মধ্যে ময়মনসিংহে প্রথম ২০১৭ সালে ওয়ান স্টপ সার্ভিস চালু হয়। হাইওয়েতে দুর্ঘটনাসহ জরুরি রোগীদের একই স্থানে ২৪ ঘণ্টা তাৎক্ষণিক চিকিৎসাসেবার সুযোগ রয়েছে এ হাসপাতালে।’
তবে হাসপাতালটির এসব সুযোগ-সুবিধাকে মলিন করে দিচ্ছে এর অবকাঠামো ও জনবল সংকট। সূত্রমতে, বর্তমানে হাসপাতালটির ইনডোরে (ভর্তি থাকা) প্রতিদিন গড়ে প্রায় সাড়ে চার হাজার রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে। রোগীর চাপ প্রতিনিয়ত বাড়লেও তা সামাল দেয়ার মতো পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক নেই এখানে। হাসপাতালটিতে চিকিৎসকদের জন্য অনুমোদনকৃত পদের সংখ্যা ৪২৫ হলেও ফাঁকা পড়ে আছে শতাধিক। বহির্বিভাগে প্রতিদিন গড়ে চিকিৎসা নিচ্ছে পাঁচ হাজার রোগী। সেখানে চিকিৎসক মাত্র ৫০ জন।
সরজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলোর ভেতরের মেঝে, বারান্দা ও সিঁড়ির মেঝেতে গাদাগাদি করে রোগীরা বিছানা পেতে চিকিৎসা নিচ্ছে। হাসপাতালের শিশু ওয়ার্ড ও মেডিসিন ওয়ার্ডে দেখা যায়, সেখানে ভর্তি রোগীর কারণে পা ফেলার জায়গা নেই। একই অবস্থা সিসিইউ ও হৃদরোগ বিভাগে। নবজাতকদের জন্য এনআইসিইউতে ৭০টি শয্যা থাকলেও সেখানে একটি শয্যার বিপরীতে রোগী ভর্তি রাখা হচ্ছে ছয়-সাতজন।
আবার মেডিকেল কলেজ হাসপাতালটির শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্যও পর্যাপ্তসংখ্যক চিকিৎসক বা শিক্ষক নেই। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, হাসপাতালটিতে অধ্যাপক, সহযোগী ও সহকারী অধ্যাপকের পদ শূন্য আছে শতাধিক।
চিকিৎসকরা বলছেন, অপ্রতুল জনবল নিয়ে নিজেদের সাধ্যমতো সেবাকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তারা। এছাড়া আশপাশের জেলাগুলোয় ভালো মানের কোনো হাসপাতাল না থাকায় সেখান থেকেও রোগীরা এ হাসপাতালে এসে ভিড় জমায়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, ময়মনসিংহ বিভাগের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোয় মোট শয্যাসংখ্যা ১ হাজার ৬৫১, যা দেশের আট বিভাগের মধ্যে সর্বনিম্ন। বিভাগটিতে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালগুলোয় মোট শয্যা সংখ্যা ৭৭০। এদিক থেকেও সর্বনিম্ন অবস্থানে বিভাগটি। আর টারশিয়ারি হাসপাতালগুলোয় শয্যা সংখ্যার দিক থেকে বিভাগটির অবস্থান দ্বিতীয় সর্বনিম্ন। এ বিভাগের টারশিয়ারি হাসপাতালগুলোয় মোট শয্যা সংখ্যা দুই হাজার।
জনবলের পাশাপাশি বিভিন্ন রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার সরঞ্জামেরও ঘাটতি রয়েছে মমেক হাসপাতালে। হাসপাতালটিতে প্যাথলজিক্যাল, রেডিওলজি ও ইমেজিং বিভাগের প্রয়োজনীয় প্রায় সব পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও তা রোগীর চাপের তুলনায় অপ্রতুল। আবার এখানকার দুটি সিটিস্ক্যান মেশিনের মধ্যে একটি নষ্ট। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আরো ল্যাব দরকার বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি আরো অবকাঠামো নির্মাণ প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. মো. জাকিউল ইসলাম বলেন, ‘হাসপাতালের অবকাঠামো বৃদ্ধির লক্ষ্যে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দীর্ঘদিন ধরে নানা তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। নতুন ভবন হলে ক্যান্সার, কিডনি ও হৃদযন্ত্রের জটিলতা নিয়ে আসা রোগীদের উন্নত চিকিৎসা দেয়া যাবে। এছাড়া হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লস্টিক সার্জারি ভবন নির্মাণে নেয়া একটি প্রকল্প এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে।’