চিকিৎসার প্রয়োজনে পুনর্বাসন দুশ্চিন্তায় হাসপাতাল ছাড়ছেন না অনেকেই
রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আলী (ছদ্মনাম)। গত বছরের ২০ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় স্নাইপারের গুলি কোমর ভেদ করে তলপেট দিয়ে বেরিয়ে যায় তার। এতে তার খাদ্যনালি ছিঁড়ে যায়। সেই থেকে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বর্তমানে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসাধীন। এ পর্যন্ত পাঁচটি হাসপাতালে একাধিকবার তার অপারেশন হয়েছে। পাঁচ-ছয় মাস পর আরেকবার অপারেশন করাতে হবে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
চিকিৎসা ব্যয় ও দৈনন্দিন খরচ নির্বাহ এবং ভবিষ্যৎ জীবন নিয়ে অনিশ্চয়তার কথা তুলে ধরে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘আমার বাবা একজন ড্রাইভার। তার অল্প আয়ে সংসার চলে। তার পক্ষে আমার চিকিৎসা ব্যয় নির্বাহ করা কষ্টকর। পড়াশোনা করছি পরিবারের হাল ধরার উদ্দেশ্যে। এ শরীর নিয়ে কীভাবে কাজ করব। আবার আমি পারব না ভিক্ষার থালা নিয়ে রাস্তায় নামতে। সরকারের কাছে অনুরোধ আমাকে যেন পুনর্বাসন করে। আমার ভবিষ্যৎ জীবনে চলার মতো ব্যবস্থা করে দেয়।’
মোহাম্মদ আলীসহ সাত-আটজন হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র নিয়ে বাসায় চলে যাওয়ার মতো অবস্থায় থাকলেও পুনর্বাসনের দুশ্চিন্তাসহ বিভিন্ন কারণে তারা হাসপাতাল ছাড়ছেন না বলে জানিয়েছেন বিএসএমএমইউর উপপরিচালক আবু নাসের। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত যে ৩০ জন ভর্তি রয়েছেন তাদের অনেকেই গুলিবিদ্ধসহ বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আছেন। তাদের সমস্যাগুলো বেশ জটিল। অনেকে পঙ্গুত্ববরণ করেছেন। তবে ছয়-সাতজন আছেন যারা চাইলে রিলিজ নিতে পারেন, কিন্তু নিচ্ছেন না। কেননা তারা কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন। পরিবারের আর্থিক সক্ষমতা না থাকায় সংসার চালাতে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। তাদের অনেকে পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন। তাই চিকিৎসকরা ছেড়ে দিতে চাইলেও রোগীরা ছাড়ছেন না। ফলে আমরাও জোর করতে পারছি না। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন আহতদের ১ লাখ ও নিহতদের জন্য ৫ লাখ টাকা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু তা পুনর্বাসনের জন্য যথেষ্ট নয়। বর্তমান বাজারমূল্য অনুযায়ী এ অর্থ পুনর্বাসনের জন্য অপ্রতুল। কেননা পুনর্বাসন একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। কর্মজীবী মানুষকে সক্ষমতা অনুযায়ী কাজের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খরচের ব্যবস্থা করতে হবে। এভাবে মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী পুনর্বাসন করতে হবে। তবেই জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সার্থকতা আসবে।’
শুধু বিএসএমএমইউ নয়, রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে এখনো চিকিৎসাধীন ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত তিন শতাধিক ব্যক্তি। যাদের অধিকাংশই গুলিবিদ্ধ বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের চিকিৎসকরা। হাসপাতালগুলোর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আহতদের বিশাল একটি অংশ সুস্থ হওয়ার পরও পুনর্বাসনের অর্থ না পাওয়ার শঙ্কাসহ নানাবিধ কারণে হাসপাতাল ছাড়তে চাচ্ছেন না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে বর্তমানে ৯৫ জন আছেন, যাদের সবাই ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে চোখে গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। কারো একটি চোখ, কারো বা দুটি চোখ আক্রান্ত হয়েছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। তবে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এদের মধ্যে অর্ধেকই রিলিজ নিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার মতো। কিন্তু সরকারের কাছে বিভিন্ন সময় দাবিদাওয়া তুলে ধরা, পুনর্বাসন নিশ্চিত হওয়া এবং অনুদান পাওয়ার আশায় হাসপাতালেই অবস্থান করছেন তারা।
জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (নিটোর) বর্তমানে দুই নারীসহ প্রায় ৯১ জন আহত ভর্তি রয়েছেন। হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. আবুল কেনান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের এখানে যারা ভর্তি আছেন, তাদের সবার অবস্থা স্থিতিশীল। হাসপাতালে থাকা জরুরি নয়, এমন আছেন ২৫ জনের মতো। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, তারা হাসপাতালে ভর্তি না থাকলেও চলবে। বাড়ি গিয়ে নিকটস্থ হাসপাতালে চিকিৎসা চালিয়ে নিতে পারবেন। যাদের নিয়মিত থেরাপি নেয়ার প্রয়োজন হয়, তারা নিকটস্থ হাসপাতাল থেকেও নিতে পারবেন। আমাদের এখানে এসে তারা শুধু নিয়মিত ফলোআপ করালেই চলবে। তার পরও আমরা জোরপূর্বক কাউকে রিলিজ দিই না। তবে কেউ যদি যেতে রাজি হয় তাহলে দিই।’
প্রসঙ্গত, ১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহতদের সারা দেশে সব সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হেলথ কার্ড বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ সেবার মাধ্যমে যেকোনো সময় দেশের যেকোনো সরকারি হাসপাতালে কার্ডধারীরা চিকিৎসা পাবেন। এ কার্ড সবসময়ই তাদের কাছে থাকবে।
আহতরা হাসপাতাল না ছাড়ার কারণ জানতে চাইলে নিটোর পরিচালক ডা. মো. আবুল কেনান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তারা একটি বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে সময় পার করেছেন। ভবিষ্যতে তারা কী সহযোগিতা পাবেন সে বিষয়ে নিশ্চিত হতে চান। এ রকম অনেক কারণে তারা এখানে থাকাকে নিরাপদ মনে করছেন। আরেকটি কারণ পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া। এটা যাতে দ্রুত হয়, সেজন্যও অনেকে থেকে যাচ্ছেন। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশন সাময়িক আর্থিক সংকট মোকাবেলা করেছে। কিন্তু আমাদের এখানকার আহতরা প্রায় সবাই অচল। তারা পরিবারের জন্য এখন বোঝা। তাদের দীর্ঘমেয়াদি ও ভবিষ্যতের নিরাপত্তার জন্য আরো বেশি অর্থের প্রয়োজেন। একজন অচল মানুষের সারা জীবনের খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দেয়া প্রয়োজন। জুলাই স্মৃতি ফাউন্ডেশনের সাময়িক উদ্যোগকে সাদুবাদ জানাই। তবে কর্মসংস্থান ও সম্মানের সঙ্গে সমাজে বাঁচার জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব নেয়া প্রয়োজন।’
এদিকে আহতদের পুনর্বাসনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুস বলেন, ‘অভ্যুত্থানে শহীদ পরিবার ও আহতদের আর্থিক নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। তাদের আর্থিক নিরাপত্তা সরকার নিশ্চিত করবে। তবে এর পাশাপাশি জুলাইয়ে আহতদের মানসিকভাবে, সামাজিকভাবে পুনর্বাসন করার বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। এটাকে গুরুত্ব দিতে হবে। মানুষগুলো যেন আনন্দে জীবনযাপন করতে পারে, সমাজে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সে বিষয়ে যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে। যার যেটাতে আগ্রহ আছে তারা যেন সে কাজটি আনন্দ নিয়ে করতে পারে, ধাপে ধাপে সেটার পথ তৈরি করে দিতে হবে। চিকিৎসা দিয়ে শারীরিকভাবে সুস্থ করার পাশাপাশি তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে।’