বৈষম্যের বাস্তবতায় অসহায় কিডনি রোগী

রতিনিয়তই বাড়ছে কিডনি রোগীর সংখ্যা। সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রতি ১০ জনের মধ্যে একজন কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছেন। আগামী দশ বছরের মধ্যে এদের মধ্যে ১০ শতাংশের কিডনি বিকল হওয়ার আশঙ্কা ন্যূনতম শতকরা ১০ ভাগ, এর ১০ শতাংশের আবার প্রয়োজন হতে পারে ডায়ালাইলিসস বা প্রতিস্থাপন। খুবই ভয়ানক তথ্য।
কিডনির নিজের খুব কম রোগই আছে। তবে প্রায় সব ধরনের কিডনি ও মূত্রতন্ত্রের রোগ এবং ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপের মতো অন্যান্য অনেক রোগে শেষ পর্যন্ত কিডনি বিকল হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তার মানে মোটামুটি সবারই কিডনি বিকল হওয়ার ঝুঁকিকে গুরুত্ব সহকারে নেয়া উচিত। কিডনি রোগের চিকিৎসা তথা ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপন খুবই ব্যয়বহুল। প্রয়োজন হলেও অনেকের জন্যই এটি সাধ্যের বাইরে। অনেকে আবার বেশ কাঠখড় পুড়িয়ে শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত চিকিৎসা চালাতে পারেন না। তার ওপর আবার প্রতিনিয়ত রোগ নিরূপণী ও চিকিৎসা ব্যবস্থার নতুন নতুন সংযোজনের ফলে ব্যয় আরো বাড়ছে।
বিভিন্ন সমীক্ষা ও জরিপ এবং মতবিনিময়ে প্রাপ্ত ফলাফলে দেখা যায়, সাধারণত রোগীরা চিকিৎসা নেয়ার ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হন, তা হলো সময়মতো রোগ নির্ণয়ে ব্যর্থতা, ডায়ালাইসিসের অপ্রতুলতা, ডায়ালাইসিসের উচ্চ মূল্য, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ওষুধ ও অন্যান্য সামগ্রীর ব্যয়, দক্ষ চিকিৎসা সেবাদানকারীর অভাব, সেবাদানকারী সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, যথাযথ তদারকি ও পরিবীক্ষণের অত্যল্পতা, চিকিৎসাসেবায় আরোপিত ভ্যাট ও ট্যাক্স ইত্যাদি।
এ বৈষম্যকে দুইভাবে বর্ণনা করা যেতে পারে—১. সুযোগের অভাব ও ২. সামর্থ্যের অভাব। সুযোগ ও সামর্থ্যের অভাবের কারণেই বেশির ভাগ কিডনি বিকল হওয়া রোগী চিকিৎসা বন্ধ করে দেন বা যেনতেনভাবে চালিয়ে যান। আর এর ফলাফল রোগভোগ এমনকি অকালমৃত্যু। সাধারণ সামর্থ্যের একটি পরিবারে একজন কিডনি রোগে আক্রান্ত হলে তার প্রভাব পড়ে পুরো পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর। এমনকি অনেক পরিবার কিডনি রোগের চিকিৎসা চালাতে গিয়ে নিঃস্বও হয়ে যায়। ফলে কিডনি রোগের ক্ষেত্রে পরিস্থিতি যেন আর্থসামাজিক ও মানবিক বিপর্যয়ের মহামারীর মতো। পরিবারগুলোর স্বজন হারানোর কষ্টের সঙ্গে অবধারিতভাবে যুক্ত হচ্ছে দারিদ্র্য আর টিকে থাকার লড়াই।
এদিকে দিনে দিনে চিকিৎসাসেবার মূল লক্ষ্য মানবিকতা থেকে পরিবর্তিত হচ্ছে ব্যবসায়। ফলে গড়ে উঠছে পাঁচ তারকা হোটেলের মতো ব্যয়বহুল হাসপাতাল। এসব হাসপাতালের ব্যয় বহন করা বাংলাদেশের অধিকাংশ রোগীরই সাধ্যের বাইরে। অন্যান্য বৈষম্যের পাশাপাশি চিকিৎসার এ ব্যবস্থা দুর্নীতির প্রসারেও ভূমিকা রাখছে। সাধারণ মানুষের উন্নত চিকিৎসা নিশ্চিত করতে প্রয়োজন এ বৈষম্যের আশু অবসান। আর এজন্য গোষ্ঠী, ব্যষ্টি ও সমষ্টির সংঘবদ্ধতায় কিডনি রোগীদের চিকিৎসা পুনর্বাসনকে সমাজায়ন করতে হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার খ্যাতনামা প্রবক্তা ডা. মরিস কিং তৃতীয় বিশ্বের জন্য সাতটি স্বাস্থ্য সারণি দিয়েছেন—১. একজনের জন্য সবকিছু নয়, সবার জন্য কিছু না কিছু, ২. স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ সবচেয়ে মুনাফাজনক, ৩. গভীরতার ব্যাপক ও যথাযথ সমন্বয়, ৪. কম খরচে সর্বোচ্চ গুণগত লাভালাভ, ৫. লাগসই প্রযুক্তি, ৬. গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণকারী বানানো এবং ৭. স্বাস্থ্য ও চিকিৎসাসেবাকে জনগণের আয়ত্তে নিয়ে যাওয়া।
‘আশু রোগ শনাক্তকরণেই কিডনি সুরক্ষা’—এ প্রতিপাদ্য নিয়ে ২০২৫-এর বিশ্ব কিডনি দিবসের আলোচনা, সেমিনার, টক শো ইত্যাদি মানুষের কতটুকু উপকারে আসবে, জানি না। এখানে আমরা পরস্পর নিজেদের জ্ঞানের পরিসঞ্চালন করে হয়তো তৃপ্তি পাব, কিন্তু ফলপ্রসূ কতটা হবে তা ভেবে দেখতে হবে। এ ধরনের মিথষ্ক্রিয়া ও তথ্য পরিসঞ্চালন করতে হবে অংশীজনদের নিয়ে, যারা জনস্বার্ধে জনকল্যাণে পরিবর্তন আনার কর্তৃত্ব ধারণ করেন। সহযোগী হবেন কিডনি রোগী। ক্ষমতা, অর্থ, শক্তি আর সংযোগের মাধ্যমে গতিশীল সামাজিক তোলপার গড়ে তোলার মাধ্যমেই হতে পারে প্রকৃত সমাধান। যেমন করেছিলেন কিডনি বিকল রোগী সেফ গ্লেজার। তিনি ডায়ালাইসিসরত অবস্থায় মেশিনসহ যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসে ঢুকে তার বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন। আর এর ফলাফল—যুক্তরাষ্ট্রের কিডনি রোগীর অধিকার আইন। কিডনি ডায়ালাইসিস ও প্রতিস্থাপনই যুক্তরাষ্ট্রের একমাত্র চিকিৎসা, যার ব্যয় সরকার বহন করে। আরেকজন আইনজীবী উইলিয়াম ব্রেভারবিজ যুক্তরাজ্যের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলির মাধ্যমে চালু করেছিলেন বিশ্বখ্যাত ব্রিটিশ এনএইচএস। আমরা নেফ্রোলজিস্টরা যদি অংশীজনদের নিয়ে এ ধরনের সামাজিক আন্দোলন করতে পারি তবে সেটিই হবে কিডনি দিবস পালনের আসল সার্থকতা; যা হবে পেশা, বিজ্ঞান, জনগণ সবার জন্য কল্যাণকর; হবে সোশ্যাল বিজনেসের আরেক প্রয়োগ, বৈষম্যের অবসান, এর অন্যথা হবে কথার ফুলঝুরি।
লেখক:অধ্যাপক ইমরান বিন ইউনুস: ইন্টারনিস্ট ও নেফ্রোলজিস্ট, প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান নেফ্রোলজি ও অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ