চাহিদার ৯৭% ওষুধই মেলে না দেশের সবচেয়ে বড় কিডনি হাসপাতালে
রাজধানীর জুরাইনের বাসিন্দা হালিমা আক্তার দীর্ঘদিন ধরে কিডনির জটিলতায় ভুগছেন। বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে তিনি চলতি মাসের শুরুর দিকে এ রোগের জন্য দেশের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল জাতীয় কিডনি রোগ ও ইউরোলজি ইনস্টিটিউটে (এনআইকেডিইউ) যান। তবে এর সেবার মান নিয়ে তার বিস্তর অভিযোগ। চিকিৎসকের দেয়া সাতটি ওষুধের মধ্যে হাসপাতাল থেকে পেয়েছেন কেবল দুটি। এছাড়া বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় সিরিঞ্জ ও অন্যান্য ওষুধ সরবরাহের কথা থাকলেও তিনি কিছুই পাননি। কিনতে হয়েছে বাইরে থেকে।
ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম সংকট থাকায় এনআইকেডিইউতে চিকিৎসা নিতে আসা বেশির ভাগ রোগীকেই বাইরের ফার্মেসির দ্বারস্থ হতে হয়। যদিও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ১০২ ধরনের ওষুধ সরবরাহের ঘোষণা দিয়েছে, যেখানে মিলছে কেবল ২০-২৫টি। কর্তৃপক্ষ বলছে, বরাদ্দ না থাকায় প্রয়োজনীয়সংখ্যক ওষুধ সরবরাহ করতে পারছে না দেশের বৃহত্তম এ কিডনি হাসপাতাল। বর্তমানে রোগীদের দেয়া হচ্ছে চাহিদার মাত্র ৩ শতাংশ ওষুধ। বাকি ৯৭ শতাংশ কিনতে হচ্ছে বাইরে থেকে।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরে এনআইকেডিইউর ওষুধের চাহিদা ছিল ৩৮ কোটি টাকার। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটি এখন পর্যন্ত মাত্র ১ কোটি ২৫ লাখ টাকার ওষুধ কিনেছে।
সরকারি হাসপাতালগুলো মূলত দুভাবে ওষুধ কেনে—এসেনশিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেডের (ইডিসিএল) কাছ থেকে এবং টেন্ডারের মাধ্যমে। নিকডো চলতি অর্থবছরে ইডিসিএলে ১৩ কোটি টাকার ওষুধের চাহিদা দিয়েছে। বিপরীতে মাত্র ৬৩ লাখ ২২ হাজার টাকার ওষুধ পেয়েছে। অন্যদিকে টেন্ডারের মাধ্যমে ওষুধের চাহিদা ছিল ২৫ কোটি টাকার। বিপরীতে কেনা হয়েছে ৬২ লাখ ৩৩ হাজার টাকার।
দেশের সবচেয়ে বড় কিডনি প্রতিষ্ঠান এনআইকেডিইউয়ে প্রতিদিন কয়েক হাজার রোগী বহির্বিভাগে চিকিৎসা নিতে আসে। এছাড়া রয়েছে ৫০০টি শয্যা, যেখানে রোগী ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেয়। এসব রোগীর ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম হাসপাতাল থেকেই সরবরাহ করার কথা। এনআইকেডিইউ থেকে রোগীরা কী কী সেবা পাবে এবং সেবামূল্যসংবলিত একটি সাইনবোর্ড টানানো হয়েছে। তাতেও লেখা আছে, ১০২ ধরনের ওষুধ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বিনামূল্যে রোগীদের সরবরাহ করবে।
সম্প্রতি রেদওয়ান নামে এক বয়োবৃদ্ধের সঙ্গে হাসপাতালের ওষুধ সংগ্রহের কক্ষের পাশে কথা হয়। তিনি জানান, চিকিৎসক তাকে পাঁচটি ওষুধ দিয়েছেন। হাসপাতাল থেকে মাত্র একটি সরবরাহ করা হয়েছে তাকে। বাকি ওষুধের বিষয়ে জানতে চাইলে বৃদ্ধ বলেন, ‘অনেক অপেক্ষার পর ডাক্তার দেখাতে পেরেছি। এখন যে একটি ওষুধ পেয়েছি এটাই তো অনেক বেশি। যদিও নিয়ম অনুযায়ী সব ওষুধই হাসপাতাল থেকে দেয়ার কথা ছিল। এখন না দিলে আমাদের কী আর করার আছে।’
রোগীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিকডোর চিকিৎসা সরঞ্জামের সংকটও প্রকট। মায়ের কিডনি পরীক্ষার জন্য গতকাল হাসপাতালে এসেছিলেন আফরিন আক্তার। তাকে বলা হয়, ‘রক্ত নেয়ার সিরিঞ্জ নেই। বাইরে থেকে কিনে নিয়ে আসেন।’ যারা হাসপাতালে ভর্তি, তাদেরও অনেক ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম হাসপাতালের বাইরে থেকে কিনে আনতে হচ্ছে বলে জানান ওই স্বজন।
জানতে চাইলে হাসপাতালটির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ওষুধ কেনার জন্য বরাদ্দ খুবই কম। গত ১০ অর্থবছর এভাবেই চলছে হাসপাতালটি। প্রতি বছরই হাসপাতাল থেকে প্রয়োজনীয়সংখ্যক ওষুধের তালিকা দেয়া হয়। ইডিসিএলের জন্য দেয়া হয় আলাদা চাহিদা। আবার টেন্ডারের মাধ্যমে কেনার জন্য পৃথক চাহিদাপত্র দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের বরাদ্দ বাড়ানো হয় না। ফলে চাহিদার ৯৭ শতাংশ ওষুধই কেনা সম্ভব হয় না।’
হাসপাতালটির বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়েও সন্তুষ্ট নন বলে জানিয়েছেন রোগীদের অনেকে। একাধিক রোগীর সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, কোনো পরীক্ষা করাতে গেলে দীর্ঘ সময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। বিশেষ করে আল্ট্রা কিউবি টেস্টের ক্ষেত্রে বেশি হয়রানি হতে হয় রোগীদের। দৈনিক ৫০টির বেশি আল্ট্রার সক্ষমতা না থাকায় এখানে প্রতিদিনই অসংখ্য রোগীকে এসে ফিরে যেতে হয়।
হাসপাতালে ওষুধের অপ্রতুলতাসহ অন্যান্য সংকটের বিষয়টি অকপটে স্বীকার করে নেন নিকডোর উপপরিচালক আবু আহমদ আল মামুন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এটা ঠিক, আমরা চাহিদার খুব অল্প পরিমাণ ওষুধ সরবরাহ করতে পারি। তবে এ সমস্যা মেটানোর জন্য কাজ শুরু করেছি। চলতি মাসের মধ্যেই আমরা ওষুধের জন্য টেন্ডার আহ্বান করব।’
আল্ট্রার ক্ষেত্রে রোগীদের হয়রানির বিষয়টিও তিনি স্বীকার করে বলেন, ‘আউটডোরে দৈনিক ৫০ জন এবং ইনডোর ও বিশেষ মিলিয়ে ৮০টি আল্ট্রা করতে পারি। এটা ১২০-১৩০ করতে পারলে আমরা স্বস্তি পেতাম। এটা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষেত্রে আমাদের সক্ষমতা ভালো মনে করছি।’