কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ, প্রাণ হারায় বছরে পৌনে দুই কোটি মানুষ
বর্তমানে জীবন ব্যবস্থার পরিবর্তন হয়েছে অনেক। তার মধ্যেও শিশু থেকে শুরু করে অল্পবয়সী, মধ্যবয়সী কিংবা বয়স্কদের মধ্যে সংক্রামক ব্যাধির হার কমার কারণ মানুষের সচেতনতা। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিংবা পুরো বিশ্বের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার অবদান অবশ্যই স্বীকার করতে হবে। অন্যদিকে অসংক্রামক রোগ যেমন কার্ডিওভাসকুলার, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ইত্যাদিতে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এজন্য অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দায়ী আমাদের নিজেদের জীবন ব্যবস্থা ও অস্বাস্থ্যকর জীবনযাপন।
কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ কী?
কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বা রক্ত সংবহনতন্ত্রের রোগ শব্দটি হৃৎপিণ্ড বা রক্তনালিকে প্রভাবিত করে এমন কোনো অবস্থাকে বর্ণনা করতে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে প্রায় প্রতি বছর ১ কোটি ৭৯ লাখ মানুষ এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর প্রধান এবং অন্যতম কারণ কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ বলতে আমরা সাধারণত হৃদরোগ, স্ট্রোক, উচ্চরক্তচাপসহ বিভিন্ন রোগকে বুঝি।
হৃদরোগ: হৃদরোগ বলতে সাধারণত করোনারি হার্ট ডিজিজকে বোঝানো হয়। এর কারণে হৃৎপিণ্ডে রক্ত সরবরাহকারী ধমনিগুলো সরু বা অবরুদ্ধ হয়ে যায়। এ রোগের কারণে বুকে ব্যথা বা হার্ট অ্যাটাক হতে পারে।
স্ট্রোক: স্ট্রোক সাধারণত দুই ধরনের হয়। রক্তনালি বন্ধ হয়ে হতে পারে ইসকেমিক স্ট্রোক আর রক্তক্ষরণ হয়ে হতে পারে হেমোরেজিক স্ট্রোক। স্ট্রোক হলে শরীরের এক পাশে অসাড়তা বা দুর্বলতা দেখা দেয়। কথা বলতে না পারা বা কথা বুঝতে অসুবিধা হতে পারে। তীব্র মাথাব্যথাও থাকতে পারে।
উচ্চরক্তচাপ: উচ্চরক্তচাপের কোনো লক্ষণ অনেক সময় নাও থাকতে পারে। গবেষণায় দেখা গেছে যে উচ্চরক্তচাপ থেকে স্ট্রোক, হার্ট অ্যাটাক, কিডনি অকেজো হওয়া এবং আরো নানা ধরনের সমস্যা হতে পারে। এ সমস্যা দেখা দিলে ঘাড়ে ব্যথা হতে পারে। মাথাব্যথাও অনেক রোগীর প্রধান লক্ষণ।
কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের ঝুঁকির কারণ: কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের জন্য বিভিন্ন ঝুঁকির কারণ রয়েছে। এসব ঝুঁকিকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। এক. যেসব ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব যেমন ধূমপান, উচ্চরক্তচাপ, উচ্চ কোলেস্টেরল, স্থূলতা ও শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা ইত্যাদি। দুই. যেসব ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয় যেমন বয়স, পারিবারিক ইতিহাস, জেনেটিকস।
কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজ নির্ণয়: সাধারণত যেকোনো রোগের চিকিৎসা ইতিহাস, শারীরিক পরীক্ষা এবং ডায়াগনস্টিক পরীক্ষার সমন্বয়ে করতে হয়। কার্ডিওভাসকুলার রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ইসিজি (ইলেকট্রোকার্ডিওগ্রাম), ইকো কার্ডিওগ্রাম ও স্ট্রেস পরীক্ষা করা হয়। তাছাড়া কোলেস্টেরল পরীক্ষা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষা করা যেতে পারে।
চিকিৎসা: এ রোগের চিকিৎসা নির্ভর করে রোগের ধরন এবং তীব্রতার ওপর। এ রোগে আক্রান্ত হলে সাধারণত রক্ত পাতলাকারী ওষুধ, স্ট্যাটিন এবং উচ্চরক্তচাপের ওষুধ দেয়া হয়। অস্ত্রোপচার প্রয়োজন পড়লে এনজিওপ্লাস্টি বা বাইপাস সার্জারি প্রয়োজন হতে পারে।
জীবনধারা পরিবর্তন: কার্ডিওভাসকুলার রোগ প্রতিরোধে জীবনধারা পরিবর্তন আবশ্যকীয়। সেজন্য ধূমপান ত্যাগ করা, নিয়মিত ব্যায়াম করা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, ফাস্টফুড ও কোমল পানীয় পরিহার করা দরকার।
নারী ও বয়স্কদের ওপর প্রভাব: হৃদরোগ ও স্ট্রোক বৃদ্ধ পুরুষ ও নারী উভয়কেই প্রভাবিত করতে পারে। তবে নারীর ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় উপসর্গ কম অনুভব হতে পারে এবং লক্ষণগুলো অনেকাংশেই অস্পষ্ট হতে পারে। বিশেষ করে মেনোপজের সময় এ রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। ইস্ট্রোজেন ও প্রজেস্টেরন হরমোনের ভারসাম্য হারানোর কারণে এমনটি হয়ে থাকে। বার্ধক্যকালে ধমনি শক্ত হয়ে যায় এবং ধমনিতে চর্বি ও ক্যালসিয়াম জমে সরু হয়ে যায়। এর কারণে হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা বাড়তে থাকে।
কার্ডিওভাসকুলার রোগ এবং মানসিক স্বাস্থ্য: হৃদরোগ ও উচ্চরক্তচাপের অন্যতম একটি কারণ মানসিক চাপ বা মেন্টাল স্ট্রেস। তাই যারা কার্ডিওভাসকুলার রোগে আক্রান্ত তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিক সবদিক থেকে তাদের মানসিক সহায়তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রতিরোধ: ইংরেজিতে একটি প্রবাদ রয়েছে, Prevention is better than cure। যার মানে দাঁড়ায় চিকিৎসার চেয়ে প্রতিরোধ ভালো। সুতরাং সুস্থ জীবন যাপন করার বিকল্প নেই।
পরামর্শ: নিয়মিত প্রতি বছরে অন্তত একবার স্বাস্থ্য চেকআপ করুন। পরিমিত ঘুমানোর অভ্যাস করুন। মানসিক চাপ পরিহার করুন। ধূমপান এবং কোমল পানীয় পরিহার করুন। নিজের যত্ন নিতে শিখুন। নিজেকে সময় দিন। মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কম সময় দিন। নিজে সুস্থ থাকুন এবং পরিবারকে সুস্থ রাখুন। শুধু সচেতনতাই পারে হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে।"
ডা. আয়েশা সিদ্দিকা
এমবিবিএস, এফসিপিএস
ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট